মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫

দেশি মুরগি

ad300
Advertisement
.গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে যায় বজলুল হক। বিরক্তিতে চেহারাটা এমন হয়, যেন নিম চটকে তার জিবে লাগানো হয়েছে। ঘরে পা দিয়ে মনটা অবশ্য ভালো হয়ে যায় বজলুর। ম-ম খিচুড়ির সৌরভ। বৃষ্টির দিনে এই না হলে চলে! গিন্নি ছুটে এসে বলে, ‘যাও, শিগগির একটা দেশি মুরগি নিয়ে এসো। তোমাদের আজ খিচুড়ি-মাংস খাওয়াব।’
অফিস থেকে এভাবে পালক ঝরা কাউয়ার মতো ফিরে এখনই আবার মুরগি আনতে যাওয়া! আহ্, আগের সেই দিনগুলো যে কোথায় হারাল!
দেশি মুরগির কথায় দমে যায় বজলু। আজকাল সে রকম দেশি মুরগি পাওয়া দায়। আর পেলেই-বা কী, কপালে সয় না। এই তো দুই মাস আগে অফিসের পিয়ন ইদ্রিসকে দিয়ে তার গ্রাম থেকে এক জোড়া দেশি মুরগি আনিয়েছিল বজলু। হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে দেখে সদ্য বিয়ে করা ভাতিজি আর জামাই হাজির। সঙ্গে আবার দেবর-ননদ। তারা যাই যাই করছিল, তেজি গলায় কক্ কক্ করতে থাকা মুরগি দুটো দেখেই বোধ হয় থেকে গেল। উফ্, চারটি রানই হাতছাড়া হয়ে গেল রে!
বজলুর নীরবতায় গিন্নির কপালে ভাঁজ পড়ে। এটা তুফানের তিন নম্বর সংকেত। গিন্নি কথায় খানিকটা ঝাঁজ মিশিয়ে বলে, ‘কী ব্যাপার, গা করছ না যে!’
বজলু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে, ‘ইফতারটা করেই যাই।’
এ কথায় ছাড় পেয়ে যায় বজলু। গিন্নি বলে, ‘ঘুরে-ফিরে আবার ব্রয়লার নিয়ে এসো না। এসব বাচ্চাদের আর খাওয়াব না।’
ইফতার সেরে আরও খানিকটা সময় আলসেমিতে পার করে দেশি মুরগি কিনতে বেরোয় বজলু। বাসার অদূরে কাঁচাবাজারে মুরগি নেই। খাঁচা সব খালি। ঝিমোতে থাকা এক মুরগিওয়ালা গলা টান করে বলে, ‘বিষ্টিতে মুরগার সাপ্লাই নাই। দিতাম কইথন?’
পাতলা বর্ষায় কালো মেঘ দেখে বজলু। বাজারে দেশি মুরগি নেই—বাসায় বোঝানো যাবে না। কী করা যায়? পরিচিত মুদি দোকানি আলতু মিয়া পথ বাতলে দেয়, ‘রমিজ্যার দোকানে যান। ওই হানে ব্রয়লারের সাতে দেশি মুরগিও পাবেন।’
সে এক দোকান বটে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, এ গলি-সে গলি ঘুরে সেই আলী বাবার গুহা। আর কী গজব! দোকানে পা দেওয়া মাত্র বিদ্যুৎ ফুঁ।
মোম জ্বেলে ভুতুড়ে এক পরিবেশ তৈরি করল রমিজ। ছায়ার মতো ঘুরছে হাতে গোনা কয়েকটা ব্রয়লার। এর মধ্যে দেশি মুরগি কই?
রমিজের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে বজলু ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘দেশি মুরগি আছে?’
রমিজ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘থাকব না ক্যান? তয় একটাই আছে। সাইজও বড়। দাম বেশি পড়ব।’
অকূলে কূল পেল বজলু। দাম কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু চিকন সন্দেহ দমিয়ে রাখা গেল না। বলেই ফেলল, ‘দেইখেন, বিদেশি না তো আবার?’
আবছা অন্ধকার কোণ থেকে এবার ঝাঁজিয়ে ওঠে বজলুর সহকারী ছোকরা। বলে, ‘কী যে কন আংকেল! এইটা এক্করে খাঁটি দেশি মুরগা। এইটা খালি কক্ কক্ করে না, মামা কইয়া ডাকে।’
রমিজ ধমকে ওঠে, ‘এই বেহুদা, ফালতু কথা কইবি না। মুরগাডা বাইর কইরা দেহা।’
আধো অন্ধকার আরেকটা কোণ থেকে মোরগটাকে বের করে ছোকরা। নিজের কথায় অটল থেকে বলে, ‘ফালতু কথা আমি কই না, মামা। এইডা সত্যি মামা কইয়া ডাকে। তয় সবাইরে কয় না, যারে পছন্দ, তারে মামা ডাকে।’
রমিজ তেড়ে গিয়ে বলে, ‘আরেকটা কথা কইলে চটকনা খাবি। বেয়াদ্দব কোনহানকার!’
চড় খাওয়ার ভয়ে ছোকরা মুখে কুলুপ আঁটে। বজলু হাতে নিয়ে দেখে মোরগটাকে। সত্যিই ওজনদার। তবে দেশি কি না, আবছা আলোতে বোঝা যাচ্ছে না। কী আর করা, কানা মামার কাজ চলবে। কেজিপ্রতি দাম একটু বেশিই চাইল দোকানি। বজলু নিরুপায়। মুঠোফোনের ক্যালকুলেটরে হিসাব করে দাম মেটাল সে। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় ড্রেসিং হবে না। মোরগটার দুপা যে বেঁধে দেবে, সে দড়িও নেই। না বেঁধেই ঝুলিয়ে নিতে হবে।
আবার সেই গলি-ঘুপচি পথ। সমস্যা হচ্ছে আলো। বিদ্যুৎ না থাকায় প্রায় পুরোটা পথ আঁধারে ঢাকা। রমজান মাসের এ সময়টাতে রাস্তাও থাকে ফাঁকা। গত কয়েক দিনে এসব রাস্তায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি করেছে খোদকেরা। কোথায় কোন গর্ত গিলে খেতে হাঁ করে আছে, কে জানে?
আচমকা বেসুরো কণ্ঠ, ‘মামা-আ-আ, মামা-আ-আ...’
আঁতকে ওঠে বজলু। এ যে সত্যিই মামা ডাকছে! মোরগে মামা ডাকে—এ কেমন কথা! কেয়ামত কি সন্নিকটে?
হাতের মুঠি আলগা হয়ে যায় বজলুর। ধপ্ করে মাটিতে পড়ে মোরগটা। পরমুহূর্তে কক্ কক্ করে ছুটে পালিয়ে যায় এক দিকে। বজলু কিছুই ঠাওরাতে পারে না। তখনো বেসুরো কণ্ঠ জানান দিয়ে যাচ্ছে, ‘মামা-আ-আ, মামা-আ-আ...ফোন ধরেন! মামা-আ-আ, মামা-আ-আ...ফোন ধরেন!’
বজলু এবার টের পায়, শব্দটা তার পকেট থেকে আসছে। পকেটে হাত দিয়ে আরও বেকুব বনে যায়। ক্যালকুলেটরে মুরগির দাম হিসাব করে নিজের মুঠোফোন ওই দোকানের টেবিলে রেখে পাশে থাকা দোকানিরটা নিয়ে এসেছে।
Share This
Previous Post
Next Post

Pellentesque vitae lectus in mauris sollicitudin ornare sit amet eget ligula. Donec pharetra, arcu eu consectetur semper, est nulla sodales risus, vel efficitur orci justo quis tellus. Phasellus sit amet est pharetra

0 Comment:

আপনার একটি মন্তব্য একজন লেখককে ভালো কিছু লিখার অনুপ্ররেনা যোগাই তাই প্রতিটি পোস্ট পড়ার পর নিজের মতামত জানাতে ভুলবেন না । তবে বন্ধুরা এমন কোন মন্তব্য পোস্ট করবেন না যার ফলে লেখকের মনে আঘাত হানে ! কারণ একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপ্ররেনা জাগাই !!