শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বিশ্বের ঘুম ভাঙাল নিথর আয়লান

ad300
Advertisement

বিশ্বের ঘুম ভাঙাল নিথর আয়লান

সিরিয়ার শিশু আয়লানের নিষ্প্রাণ শরীরটি এভাবেই ভেসে এসেছিল তুরস্কের একটি সৈকতে। বিশ্ববিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে ছবিটি। বালু দিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ফুটিয়ে তুলেছেন সুপরিচিত ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক। ভাস্কর্যের পাশে তিনি লিখেছেন, ‘ভেসে যাওয়া মানবতা...লজ্জা লজ্জা লজ্জা’।  ওডিশা রাজ্যের পুরী সৈকত থেকে গতকাল তোলা ছবি l এএফপি‘আমার সন্তানেরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু। ওরা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙাত। খেলা করত আমার সঙ্গে। এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে? এ সবকিছুই হারিয়ে গেছে।’
শোকার্ত এই উচ্চারণ সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারানোর পর আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। তুরস্ক থেকে নিজ দেশ যুদ্ধপীড়িত সিরিয়ার কোবানিতে ফিরে তিনি গতকাল শুক্রবার দাফন করেছেন প্রিয়জনদের।
গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়া থেকে এই কুর্দি পরিবারটি আশ্রয় নিয়েছিল তুরস্কে। বুধবার তুরস্ক থেকে নৌকায় চেপে গ্রিস যাওয়ার চেষ্টা করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় আবদুল্লাহর পরিবার। নৌকা ডুবে গেলে তাঁর হাত ফসকেই সাগরের ঢেউয়ে তলিয়ে যায় দুই ছেলে—তিন বছর বয়সী আয়লান আর পাঁচ বছর বয়সী গালিব। ভূমধ্যসাগর কেড়ে নিয়েছে ওদের মা রেহানাকেও।
তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা আয়লানের ছোট নিথর দেহের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায় অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপ। ঘুম ভাঙে বিশ্ববাসীরও। সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আয়লানের ছবিটি অনেকখানি পাল্টে দিয়েছে জনমত। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ইউরোপের যে নেতারা এত দিন নির্লিপ্ত ছিলেন, তাঁরাও এখন মানবিক উদ্যোগের পথে এগোনোর কথা বলছেন। অন্তত দুই লাখ অভিবাসীকে গ্রহণ করতে ইউরোপকে অনুরোধ করেছে জাতিসংঘ।
শিশু আয়লানের মরদেহ দুর্ঘটনার দিনই তুরস্কের আরেকটি সৈকতে ভেসে আসে। এর ১০০ মিটার দূরে পড়ে ছিল তার ভাই গালিবের মরদেহ। মায়ের মরদেহ পাওয়া গিয়েছে কাছের আরেকটি সৈকতে। তুরস্কের পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।
দুই ছেলে আয়লান (বাঁয়ে) ও গালিবের হাত ধরে বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি। নতুন নিশ্চিন্ত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে সিরিয়া ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন আবদুল্লাহ। পথে নৌকাডুবিতে সবাইকে হারিয়েছেন তিনি l ছবি: এএফপিবিপজ্জনক উপায়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে এ বছর আড়াই হাজার মানুষ প্রাণ হারালেও আয়লানের ছবিটি আলাদাভাবে মর্মস্পর্শ করেছে বিশ্ববাসীর। ইতিমধ্যে কার্যত শরণার্থীদের বিপন্নতা আর মরিয়া অবস্থার প্রতীকে পরিণত হওয়া ছবিটিতে দেখা যায়, সৈকতের বালুতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে আয়লান। তার পরনে লাল জামা, নীল শর্ট প্যান্ট, পায়ে হালকা জুতা।
আলোচিত ছবিটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়। এতে রাজনীতিক ও জনসাধারণ—উভয়ের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস টুইটারে লেখেন, ‘ইউরোপকে সংহত করতে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে তৎপর হতে হবে।’
ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফ্রান্স ও জার্মানি দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে একমত হয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচিত, নির্ধারিত সংখ্যা (কোটা) অনুযায়ী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জায়গা দিতে সদস্যদেশগুলোকে বাধ্য করা। শরণার্থী ও অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও আয়লানের ছবিটি দেখে ‘গভীরভাবে প্রভাবিত’ হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর দেশ কয়েক হাজার সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে।
আনুষ্ঠানিক পোশাকে আয়লানআয়লানের হৃদয়বিদারক ছবিটি প্রকাশের পর শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের পরিমাণও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) গত দুই দিনে সারা বিশ্ব থেকে এক লাখ ডলার সহায়তা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও সিরিয়া ও ইরাকের শরণার্থীদের জন্য জরুরি তহবিল সংগ্রহ শুরু করার পর অভাবনীয় সাড়া পেয়েছে।
ছবিটির আলোকচিত্রী তুর্কি সাংবাদিক নিলুফার দেমির বলেন, ‘যখন বুঝতে পারলাম ছেলেটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেই—মনে হলো, ওর ছবি তুলি...বেদনাদায়ক ঘটনাটা দেখুক সবাই। আশা করি, এই ছবি যে ধাক্কা দিয়েছে, তা চলমান সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।’
আবদুল্লাহর কাহিনি: কুর্দি পরিবারটি সিরিয়ার কোবানি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ইউরোপ হয়ে কানাডা যেতে চেয়েছিলেন আবদুল্লাহ। সেখানে তাঁর বোন টিমা কেশবিন্যাসের কাজ করেন।
দাফনের সময় আয়লানের বাবাতবে সব হারানো আবদুল্লাহ এখন দেশ ছাড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-সন্তানের কবরের কাছেই শান্তি খুঁজতে চান, গতকাল জানালেন তাঁর চাচা সুলেমান কুর্দি।
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুর্দি সম্প্রদায়ের মানুষেরা অন্যায়-অবিচার ও উপেক্ষার শিকার। এর মধ্যে সিরিয়ার সরকার বহু বছর ধরেই তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করছে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সে দেশের কুর্দিরা রাজধানী দামেস্কেই থাকত। একপর্যায়ে তারা উত্তরাঞ্চলীয় শহর কোবানির কাছাকাছি মাখারজি এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে কোবানিতে কুর্দি বাহিনী ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের লড়াই শুরু হলে স্থানীয় বহু পরিবার তুরস্কে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানকার কর্তৃপক্ষ কুর্দি শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় দেয়। তবে স্থায়ী আশ্রয়ের খোঁজে কুর্দিরা ইউরোপসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে।
সূত্র: এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি
Share This
Previous Post
Next Post

Pellentesque vitae lectus in mauris sollicitudin ornare sit amet eget ligula. Donec pharetra, arcu eu consectetur semper, est nulla sodales risus, vel efficitur orci justo quis tellus. Phasellus sit amet est pharetra

0 Comment:

আপনার একটি মন্তব্য একজন লেখককে ভালো কিছু লিখার অনুপ্ররেনা যোগাই তাই প্রতিটি পোস্ট পড়ার পর নিজের মতামত জানাতে ভুলবেন না । তবে বন্ধুরা এমন কোন মন্তব্য পোস্ট করবেন না যার ফলে লেখকের মনে আঘাত হানে ! কারণ একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপ্ররেনা জাগাই !!