Advertisement |
প্রতিবছর নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এত দিন চলছিল, এবার তা হোঁচট খেল। পাসের হার, জিপিএ ৫ ও শতভাগ পাস- সব মানদণ্ডে এবার ফল খারাপ হয়েছে। এই ফল খারাপের পেছনে হরতাল-অবরোধকে দায়ী করা হলেও গণিত পরীক্ষায় ব্যাপক ফেল এবং মানবিক ও ব্যবসায় শাখার খারাপ ফল এ বিপর্যয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার প্রথমবারের মতো গণিত ও উচ্চতর গণিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আটটি সাধারণ বোর্ডসহ ১০ বোর্ডের গড় পাসের হার এবার ৮৭.০৪ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৯১.৩৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে ৮৯.০৩ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ছিল ৮৬.৩৭ শতাংশ। তারও আগে ২০০৭ সালে এ হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার এই খারাপ ফলাফলের জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধকে দায়ী করেছেন। কিন্তু ফলাফলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার কমলেও মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে পাসের হার বেড়েছে। সংগত কারণে হরতাল-অবরোধই ফল খারাপের একমাত্র কারণ হলে তার প্রভাব থেকে মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডও মুক্ত থাকার কথা নয়।
শাখাভিত্তিক ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এবার মানবিক ও ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্র্থীদের ফল বিপর্যয় ঘটেছে। মানবিকে পাসের হার কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ বছর পাস করেছে ৭৯.৩২ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৮৯.২৯ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষায় এবার পাসের হার ৮৬.৯৩ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৯৪.০৬ শতাংশ। এখানেও কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। এ দুই বিভাগের ফল বিপর্যয়ই সার্বিক পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে। এ বছর বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৬.৩৫ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৯৬ শতাংশ। বিজ্ঞানে পাসের হার বেড়েছে।
বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার গণিত বিষয়ে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা, যা সার্বিক ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরাই গণিতের এই সৃজনশীল পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে।
এবার বাংলা দ্বিতীয়পত্র, ইংরেজি প্রথমপত্র, ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র ছাড়া সব বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। মোট ২৩টি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতিতে। চতুর্থ বিষয়সহ এবার এক হাজার ২০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছে। প্রথমবারের মতো শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা নামে নতুন বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে।
বোর্ডগুলোর মধ্যে গত বছর গণিত বিষয়ে পাসের হার ছিল ৯৬ থেকে ৯৮ শতাংশ। এবার ১০ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট ও দিনাজপুর- ছয় বোর্ডের এ বিষয়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে। এর বাইরে ৯২ শতাংশ পাস করেছে ঢাকা ও কারিগরি বোর্ডে, ৯৫.৬৫ শতাংশ রাজশাহী ও ৯৮.২১ শতাংশ মাদ্রাসা বোর্ডে। গণিতে সর্বনিম্ন পাসের হার সিলেট বোর্ডে ৮৪.৮৬ শতাংশ।
কঠিন বিষয়গুলোর মধ্যে ইংরেজিতেও কিছুটা খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। গত বছর এ বিষয়ে বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হার ছিল ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ। এবার রাজশাহী (৯৯.০৫%) এবং মাদ্রাসা বোর্ড (৯৮.৭৬%) ছাড়া বাকি আটটি বোর্ডের পাসে হার ৯৮ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৯৫.৯১ শতাংশ পাসের হার দিনাজপুর বোর্ডের। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে পাসে হার মোটামুটি গতবারের মতোই। পদার্থে ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ, রসায়নে ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ। নতুন বিষয় শারীরিক শিক্ষায় কারিগরি বোর্ড ছাড়া সব বোর্ডের শিক্ষার্থীরাই ৯৯ শতাংশের ওপরে নম্বর পেয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে পাস করেছে ৯৮.৬৮ শতাংশ।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল সিলেট বোর্ডের। গত বছর সিলেটে পাসের হার ছিল ৮৯.২৩ শতাংশ। এবার তা কমে ৮১.৮২ শতাংশে নেমেছে। গতবার তিন হাজার ৩৪১ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিল। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে দুই হাজার ৪৫২ শিক্ষার্থী। এসএসসিতে সিলেট বোর্ডের অকৃতকার্য ১৩ হাজার ৯২ শিক্ষার্থীর মধ্যে গণিতে পাস করতে পারেনি ১০ হাজার ১৭৭ শিক্ষার্থী। আর বাকি ১০ বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৯১৫ শিক্ষার্থী।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুল মান্নান খান জানান, প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত গণিত পরীক্ষায় খারাপ ফলই সার্বিক ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। এর মূল কারণ, সব স্কুলে প্রশিক্ষিত গণিত শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। শহরের স্কুলগুলো গণিতে ভালো ফল করলেও গ্রামের স্কুলগুলোতে এ বিষয়ে বেশি হারে ফেল করেছে। এ ছাড়া পরীক্ষা চলাকালে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও হরতালের কারণও প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, হরতালের কারণে পরীক্ষা পেছানোয় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে সার্বিক ফলাফলে এর প্রভাব পড়েছে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ইন্দুভূষণ ভৌমিকের মতে, হরতাল-অবরোধের কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে পরীক্ষা দিতে নিজস্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি অনুসারে পরীক্ষা দিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এটা খারাপ ফলের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিত পরীক্ষা হওয়ায় অনেকেই খারাপ করেছে। এ দুটি কারণেই এবার ফল খারাপ হয়েছে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষাও ছিল অন্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। পেছাতে হয় সবগুলো পরীক্ষাই। সব পরীক্ষাই নেওয়া হয়েছে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারে। অধিকাংশ পরীক্ষাই কবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিশ্চিত হতে হয়েছে পরীক্ষার আগের দিন। ফলে পরীক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল চরমে। এমনকি পরীক্ষাকেন্দ্রে পেঁৗছানোই তাদের অন্যতম চিন্তার বিষয় ছিল। ফলে এসএসসির তত্ত্বীয় পরীক্ষা ১০ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয় ৩ এপ্রিল। এটাও ফল খারাপের পেছনে প্রভাব ফেলেছে।
পরীক্ষা চলাকালে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ফল খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা একটি বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার পর জানে, পরীক্ষা হবে অন্য বিষয়ে। যার প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার ওপর।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষার্থীরা উদ্বেগ ও ভয় নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। এসব কারণে পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় একজনও পাস না করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩টি বেড়েছে। শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক হাজার ১১৫টি কমেছে। এবার ৪৭ প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি, গত বছর শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৪টি। অন্যদিকে এবার শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৫টি। গত বছর ছয় হাজার ২১০ প্রতিষ্ঠানের সবাই পাস করেছিল
0 Comment:
আপনার একটি মন্তব্য একজন লেখককে ভালো কিছু লিখার অনুপ্ররেনা যোগাই তাই প্রতিটি পোস্ট পড়ার পর নিজের মতামত জানাতে ভুলবেন না । তবে বন্ধুরা এমন কোন মন্তব্য পোস্ট করবেন না যার ফলে লেখকের মনে আঘাত হানে ! কারণ একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপ্ররেনা জাগাই !!